নরেন বিশ্বাস এর ভাষণ

শুদ্ধ উচ্চারণ বিষয়ক বক্তৃতা : অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস


প্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ, বাংলাদেশের বাকশিল্পাঙ্গনে আমি তোমাদের আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। তোমরা এখানে এসেছো, জানার জন্যে, কিভাবে বাংলা প্রমিত উচ্চারণে অভ্যস্ত হওয়া যায়, কিভাবে সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়? তোমরা সারাজীবন বাংলা ভাষায় লেখাপড়া করেছো, কথা বলেছো, কিন্তু তা সত্ত্বেও ভুল উচ্চারণে তোমাদের ভাষা কণ্টকাকীর্ণ আর এজন্যে প্রথমেই জানতে হবে, আমাদের প্রমিত উচ্চারণে মূল সমস্যাটা কোথায়?

বাংলা ভাষা উচ্চারণের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে প্রমিত উচ্চারণের ক্ষেত্রে সমস্যার জন্য আমি তোমাদের মূল পাঁচটি কারণের ব্যাখ্যা দিতে চাই। এই কারণগুলি হলো : 
১) বাঙলা ভাষার লিখিতরূপের সঙ্গে বহুক্ষেত্রে তার উচ্চারিত রূপ একই হয় না। 
২) বাঙলা ভাষার বর্ণ আছে একাধিক, কিন্তু তার ধ্বনি প্রতীক এক। আবার বর্ণ আছে একটি, কিন্তু তার ধ্বনি একাধিক।
৩) আমাদের উচ্চারণে প্রায়শ মহাপ্রাণ বর্ণগুলো অল্পপ্রাণ হয়ে যায়।
৪) আমাদের আঞ্চলিকতার সমস্যা।
৫) বাঙলা ভাষার প্রতি আমাদের দরদ ও আন্তরিকতার অভাব।
এজন্য আমাদের অবহেলা ও অযত্ন দায়ী।

সমস্যা নম্বর এক : আমাদের ভাষার লিখিত রূপ আর উচ্চারিত রূপ সর্বত্র এক নয়। কারণ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের বানান পদ্ধতি মূলতঃ সংস্কৃত ভাষা প্রভাবিত এবং উচ্চারণ পদ্ধতি প্রাকৃত প্রভাবিত। ফলে লিখিতরূপে যেখানে সংস্কৃত ব্যকরণের অনুসরণ; উচ্চারিতরূপে যদি প্রকৃত ব্যকরণের অনুসরণ হয় তবে এই দ্বৈরাজ্যিক প্রভাব, আমাদের ভাষার এই নৈরাজ্যিক অবস্থার জন্য দায়ী। রবীন্দ্রনাথ একবার ক্ষেদ করে বলেছিলেন, আমরা লিখি সংস্কৃত ভাষায়, কিন্তু সেটা পড়ি প্রাকৃত বাঙলায়। অর্থাৎ আমাদের বানান পদ্ধতি আর উচ্চারণ পদ্ধতি এক নয়। এ ব্যাপারে তোমাদের দু-একটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চাই। যেমন আমরা বলি আমি আত্মীয় (আত্তীঁয়) বাড়ীতে যাব, এখন এই যে আত্মীয়, এখানে ম-ফলা আছে, যদি লেখা অনুসারে পড়তে হয়, তাহলে বলতে হয় আত্মীয় বাড়ীতে যাব, না গেলে ভসমো হয়ে যায়। আসলে ভস্ম (ভস্ সো)
যেমন লেখা হচ্ছে বিশ্ব, বানান অনুসারে পড়তে গেলে বলতে হয় বিশবো। কিন্তু উচ্চারণ করা হচ্ছে বিশশো। বিদ্বান এবং উদ্যানের ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে বিদ্দান এবং উদ্দান, কিন্তু বানান অনুযায়ী যদি উচ্চারণ করা হতো তাহলে বলতে হতো বিদ্বান এবং উদ্দ্যান। সংস্কৃত লিখিতরূপে আলাদা ছিল এবং উচ্চারণও ছিল ভিন্ন। কিন্তু বাঙলাতে ঐ বানানটি নেওয়া হলো, কিন্তু উচ্চারণটি পৃথক হয়ে গেল। ফলে আমাদের লেখায় যেমন লিখতে হয়, তেমনি বলাটাও শেখার দরকার। তাহলে আমাদের জানা দরকার, বাঙলা ভাষার লিখিত রূপ এবং উচ্চারিত রূপ কোথায় এক নয়। কেন এক নয়, কিভাবে উচ্চারণ করতে হয়। এগুলো বুঝলে আর ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। এবং মূলের ভুল যদি দূর করা না যায় তাহলে কোনদিনই বিচিত্র বর্ণের ফুলও ফুটবে না।

সমস্যা নম্বর দুই : বাঙলা বর্ণমালায় আমরা বিস্ময়কর ভাবে লক্ষ্য করি, একাধিক বর্ণের ধ্বনিগত উচ্চারণ এক। যেমন দুটো ন আছে বাংলায় একটি হলো মুর্ধন্য-ণ আর একটি দন্ত্য-ন। কিন্তু এই দুটো ন কে আমরা ভিন্নরকম উচ্চারণ করি না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে জনগণ। এখানে জনতে দন্ত্য ন থাকলেও গণ এ আছে মূর্ধন্য ণ। কিন্তু উচ্চারণের সময় দুটো ন এর কোন পার্থক্য থাকছে না। আবার জ আছে দুটো। একটি বর্গীয় জ এবং আর একটি হলো অস্তস্থ য। কিন্তু জামাই এবং যম শব্দ দুটোতে দুরকম য থাকলেও উচ্চারণে কোন ভিন্নতা পাওয়া যায় না। মুখে জমে থাকা পানের রস চুক্ করে গিলে ফেলে একটু যেন অপ্রস্তুত হলেন স্যার। সামনের সারিতে বসা মুনিরা, লাবনী, খোকনদের তন্ময় ভাব লক্ষ্য করে নিজের জগতে ফিরে গেলেন যেন। গুরুগম্ভীর অথচ শ্রুতিমধুর ধ্বনিময়তা আবার আচ্ছন্ন করে ফেললো উন্মুখ হৃদয়গুলোকে। দেখো তোমরা, একটি নয়, দুটি নয়, তিনটি স। একটাকে বলে তালব্য, একটাকে বলে মূর্ধন্য আর একটাকে বলে দন্ত্য। এই যে তিনটি শ, এই তিনটি স-ই কিন্তু বাঙলা ভাষাতে আমাদের উচ্চারণে এক হয়ে যায়। কারণ আমরা শেষে কিন্তু বলি তালব্য-স, মূর্ধন্য-স, দন্ত্য-স অর্থাৎ স, ষ এবং শ। তিনটি স-এর চেহারা আলাদা উচ্চারণ এক। একটি উদাহরণ দিলে তোমাদের কাছে ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। “সবিশেষ” লিখতে তিনটি স-ই ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু উচ্চারণে তিনটি স-এর কোন ভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যায় না। পায়চারী শেষ করে চেয়ারে বসতে বসতে বলে চললেনÑ বর্ণ আছে একটি, কিন্তু তাকে ঘিরে ধ্বনি একাধিক। স্বরবর্ণের প্রথম বর্ণ-অ। এটা কোথাও ‘অ’ এর মতো উচ্চারিত হয়। আবার কোথাও ‘ও’ এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন অত (অ অবিকৃত) ভাবার দরকার নেই, অতি (অ-ও এর মতো) বাড় বেড়ো না। আমি কব (অ-অবিকৃত) না কথা, আমি কবি (অ ও এর মতো) না। আবার নটবর এবং নই শব্দ দুটোতে দেখা যাচ্ছে নটবর এর অ ঠিক অ-এর মত উচ্চারিত হয়, কিন্তু নই এর অ ও এর মতো উচ্চারিত হয়। অর্থাৎ একই অ কখনো অ-এর মতো, আবার কখনো ও এর মতো আচরণ করছে। আমরা বলি একটি একটি করে উদাহরণ দেব। আর যখন বলবো, না, একটি নয়, একটা একটা করে উদাহরণ দেব। এই যে একটি এবং একটা। যখন টি বলছি তখন এ অবিকৃত থেকে এ এর মতো আচরণ করছে। কিন্তু যখন টা বলছি তখন এ ভোল পাল্টে অ্যা এর মতো আচরণ করছে। তাহলে আমরা একই বর্ণের একাধিক উচ্চারণ লক্ষ্য করতে পারছি কিনা বল তোমরা।
আবার বললেন, তোমাদের মতি যদি ঠিক থাকে, তবে গতিও ঠিক থাকবে, আর তাতে তোমাদের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকবে না বললেই চলে।

সমস্যা নম্বর তিন : তোমরা হয়তো জানো, প্রাণ মানে বাতাস। যে বর্ণ উচ্চারণ করতে বাতাস কম লাগে তাকে বলা হয় অল্পপ্রাণ, আর বাতাস বেশী লাগলে তাকে বলি মহাপ্রাণ। বাঙলা বর্ণমালায় যে পাঁচটি বর্গ আছে, ওই প্রতিটি বর্গের দ্বিতীয় এবং চতুর্থ বর্গগুলি হচ্ছে মহাপ্রাণ। খ-ছ-ঠ-থ-ফ-ঘ-ঝ-ঢ-ধ-ভ এই দশটি বর্ণকে যদি আমরা আলাদা করে ফেলি এবং তাদের যথাযথ অনুশীলন করি, তবে প্রাণগত সমস্যার উত্তরণ ঘটবে বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়শ আমরা উচ্চারণে মহাপ্রাণ ধ্বনিকে অবহেলা, অযত্ন করি। ফলে ধ্বনি বিনষ্ট বা ম্রিয়মান হয়ে অল্পপ্রাণের মতো আচরণ করে। কখনো কখনো বিলুপ্তও করে ফেলি মহাপ্রাণ ধ্বনিকে। তোমাদের আমি দু’একটি ঘটনার কথা বলি তাতে তোমরা বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে একদিন আমার রেকর্ডিং এ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশী সময় ব্যয় হওয়ায় এক ছাত্রকে বললাম যে তুমি ফেরার পথে আমার বাসা হয়ে যেও। তোমার বৌদিকে জানিয়ে দিও, আমার ফিরতে দেরী হবে। তারা যেন আমার জন্য চিন্তা না করে। সে বললো কি জানো? বললো, স্যার আপনার বাসায় গিয়ে বৌদিকে কবর দিয়ে দেব। আমি বললাম, আমার একটি মাত্র বউ, আর তাকে তুমি জ্যান্ত কবর দিয়ে দিবে? সে কিন্তু বেশ লজ্জা পেল। আর একদিন, রোকেয়া হলের সামনে দিয়ে আমি হেঁটে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম। পরিচিত কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে দেখা হতেই জিজ্ঞেস করলাম তোমরা কি করছ? চট্ করে একজন বললো, স্যার, আমরা আমরা খাচ্ছি। আমি বললাম, ঠিক আছে, তোমরা তোমাদের খেতে থাক। আমার বরং এখান থেকে চলে যাওয়াই শ্রেয়। এরকমভাবে প্রায়শই আমাদের উচ্চারণ বিভ্রাটের ফলে ভাত হয়ে যায় বাত, খাল হয়ে যায় কাল, ঝাল হয়ে যায় জাল, কথা হয়ে যায় কতা। অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে এর স্থলে যদি বলা হয় অন্দ হলে কি প্রলয় বন্দ থাকে তাহলে অবস্থা কোন পর্যায়ে যায় তোমরা নিশ্চয় বুঝতে পারছো? ডাক্তার যদি নাড়ী ধরার পরিবর্তে নিত্যনূতন নারী ধরা শুরু করেন, তাহলে ডাক্তারী পেশা না, তার জীবন নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে না?

সমস্যা নম্বর চার : বাংলাদেশ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত। এবং সকল অঞ্চল মিলিতভাবে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একেক অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষার টান, স্বর প্রক্ষেপণ, বাকরীতি, বাক্যের সুর এবং স্বর ভিন্ন প্রকৃতির হওয়ায় অপর অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষার সঙ্গে স্পষ্ট পার্থক্য ধরা পড়ে। এটিকে বলে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা। নোয়াখালী অঞ্চলের লোক যখন ময়মনসিংহ অঞ্চলের লোকের সঙ্গে কথা বলে অথবা রংপুরের লোক যখন চট্টগ্রামের কারো সাথে কথা বলে তখন আমরা চারটি আঞ্চলিক ভাষার কথা শুনতে পাই। কিন্তু পত্র লেখার সময় সাধ্যমত আঞ্চলিক ভাষা পরিহার করে প্রমিত বাঙলায় লেখার চেষ্টা করে এরা সকলেই। তাহলে বুঝতেই পারছো লিখিত রূপটির বেলায় আমরা সচেতন থাকলেও মুখের ভাষার ব্যাপারটিতে আঞ্চলিকতা পরিহার করার কোন গরজ আমাদের নেই। অর্থাৎ লেখার ভাষা এক হলেও বলার ভাষা আলাদা। 
আমি তোমাদের আঞ্চলিক ভাষাকে অবহেলা বা উপেক্ষা করতে বলছি না। যখন তুমি মায়ের কাছে বা গাঁয়ে যাবে বা আঞ্চলিক কোন চরিত্রে অভিনয় করবে তখন আঞ্চলিক ভাষাতে কথা বললে কোন আপত্তি নাই। কিন্তু যখন সবার জন্য বলবে বা সভাতে বলবে তখন আঞ্চলিক ভাষা পরিহার করবে। তবে একটি কথা তুমি যদি সারাক্ষণ পা টেনে হাঁটতে থাকো, তবে তোমার হাঁটার ঐ বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে হঠাৎ তোমার হাঁটাহাটি সুন্দর করতে পারবে না। সুন্দর হাঁটার জন্য তোমাকে সব সময়ই সুন্দরভাবে পা ফেলার অনুশীলন করে যেতে হবে। ঠিক সেরকমই, প্রমিত ভাষার উচ্চারণ দক্ষতা অর্জনের জন্য বা উত্তরণের জন্য তোমাকে আঞ্চলিক ভাষার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করতে হবে। আঞ্চলিক ভাষাকে বর্জন করে প্রমিত ভাষার উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়ে উঠার জন্য এর কোন বিকল্প নেই। 

সমস্যা নম্বর পাঁচ : এটি হলো আমাদের জাতীয় সমস্যা তোমাদের সুন্দর পোষাক পরিচ্ছদ ও মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য যে সময় ব্যয় করে থাকো, মুখের ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য সেই সময়টুকু ব্যয় করো কিনা, তা তোমরা হলফ করে বলতে পারবে? একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি বক্তৃতা দেয়ার সময় অবলীলায় বলেছেন সনমানিত সবাপতি। কিন্তু তিনি কি ইংরেজি বক্তৃতা দেবার সময় বলবেন হনারেবল ফ্রেসিডেন্ট। কখনোই তিনি এমন ভুল করবেন না। কারণ তিনি ইংরেজি শেখেন। রপ্ত করেন, কিন্তু বাঙলা তাঁর মাতৃভাষা হলেও এটি শেখার জন্য কোন গরজ অনুভব করেন না। 

তিনটি জিনিসের ঋণ জীবনে শোধ দেওয়া যায় না। তিনটি ম। একটি হল মা, একটি হলো মাটি এবং একটি হলো মাতৃভাষা। মা আমাদের জন্ম দেয়, মাটি আমাদের লালন করে আর মাতৃভাষা আমাদের প্রকাশ করে। আসলে আত্মপ্রকাশের জন্য মাতৃভাষার কোন বিকল্প নেই। ভাষা ভাল বললে, ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটবে। কিন্তু সেটাতো এমনি এমনি ঘটবে না। তার জন্য বারংবার অনুশীলন করতে হবে। কিছু পেতে হলে তোমাকে কিছু দিতে হবে। প্রেম কখনো একতরফা হয় না। তুমি ভাষার বিনিময়ে তোমার অস্তিত্বকে বিজ্ঞাপিত করবে সুন্দরভাবে এবং তুমিও সাধনার মধ্য দিয়েই সার্থক হবে।






শুদ্ধ উচ্চারণ বিষয়ক বক্তৃতা : আদ্য ‘অ’ এর সূত্র - অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস

পর্ব : দ্বিতীয়


মানুষের মুখের ভাষা হচ্ছে জীবন্ত ও বহমান। আজকের মুখের ভাষার সঙ্গে শতবর্ষ পরের ভাষার কিছু পার্থক্য ঘটে যেতে পারে। সেজন্য আজকে আমি তোমাদের যে সূত্রের আলোচনা করবো তা একেবারে চরম সিদ্ধান্ত বলে ধরে নেয়া যাবে না। কারণ আজকের কোন সূত্র ভবিষ্যতে পরিবর্তন করার প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে কিভাবে শব্দগুলোকে উচ্চারণ করলে প্রমিত উচ্চারণ পাওয়া যায় অথবা কোন ধারা অবলম্বন করলে ভুলের থেকে অব্যাহতি পাওয়া যায় সে সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্টি বিধি বা সাধারণ সূত্র নিয়ে আমার আজকের আলোচনা। তবে সূত্রগুলোকে কেবল মাথাতে বা খাতাতে লিখে রাখলে চলবে না। প্রতিদিনের কথাতে অনুশীলন করতে হবে। না হলে শুধু ব্যথাই বহন করতে হবে তোমাদের।

বাঙলা স্বরবর্ণের প্রথম বর্ণ হচ্ছে অ। এই অ কোথাও অবিকল অ-এর মতো, আবার কোথাও ও-এর মতো উচ্চারিত হয়ে প্রবল সমস্যার সৃষ্টি করে। অ-এর উচ্চারণের সমস্যার একটি সরল সমাধান করা গেলে বাংলা উচ্চারণের চল্লিশ ভাগ সমস্যার সমাধান আপনাতেই সম্ভব হয়। এখন এই অ-এর সূত্র কি সকল ক্ষেত্রে একরকম হবে?
আমরা মুখ চাওয়া চাওয়া করছি। স্যার ঠিক কি বলতে চান, তা বুঝতে পারছি না। আমাদের ভ্যাবাচ্যাকা ভাব লক্ষ্য করে গমগমে গলায় হাসতে হাসতে বললেন, অমন চুপচাপ না থেকে টুপটাপ করে উত্তর যদি না দাও, তাহলে বুঝবো যে, তোমাদের উৎসাহে দুদিনেই ভাটা পড়বে। আর তাতে একে একে ঝুপঝাপ ঝরে পড়বে উচ্চারণের ক্লাস থেকে। ঝন্টু প্রবল প্রতিবাদ করলো, না, স্যার, আমাদের খুব ভালো লাগছে। একজনও ঝরে পড়বে না, আমরা আপনাকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারি। স্যার বোধ হয় এই কথাগুলি শুনতে চাচ্ছিলেন। বললেন, সে যাকগে, অ-এর সূত্র সবক্ষেত্রে একরকম হবে না। ‘অমন সহজ সরল’ এই বাক্যটিতে তিনটি শব্দ আছে। প্রতিটি শব্দের প্রথম বর্ণ বলার সময় অ-কারান্ত, দ্বিতীয় বর্ণের সময় ও কারান্ত আর তৃতীয় বর্ণ বলার সময় হসন্ত বলা হচ্ছে অমোন্ সহোজ্ সরোল্। কিন্তু বানানের ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রত্যেকটি বর্ণ অ-কারান্ত। অ-ম-ন/স-হ-জ/স-র-ল। প্রথম বর্ণ অর্থাৎ আদিতে একরকম নিয়ম, দ্বিতীয় বর্ণ অর্থাৎ মধ্যে অন্য রকম নিয়ম এবং তৃতীয় অর্থাৎ অন্তে আর একরকম নিয়ম। তাহলে তোমরা দেখতে পাচ্ছো, অ-এর সূত্র হবে তিনরকম। আদ্য অ-এর সূত্র, মধ্য অ-এর সূত্র এবং অন্ত অ-এর সূত্র।
প্রথমে তোমাদের আমি আদ্য অ-এর সূত্র লিখে দিচ্ছি। তোমরা এটা লিখে নাও।

আদ্য অ-এর প্রথম সূত্র : 

শব্দের প্রথমে যদি অ-থাকে (স্বাধীন কিংবা ব্যঞ্জনে যুক্ত), তারপরে ই-কার (হ্রস্ব কিংবা দীর্ঘ) উ-কার (হ্রস্ব কিংবা দীর্ঘ), ঋ-কার, ক্ষ, য-ফলা এবং জ্ঞ থাকে তাহলে তার আগের অ-কার সাধারণত ও-কার রূপে উচ্চারিত হয়।
অংকের যেমন একটি ফর্মুলা দেওয়া থাকে এবং সেই ফর্মুলাতে ফেলে অংক করা সুবিধাজনক হয়ে উঠে। আমরা তেমনি ফর্মুলার মত প্রতীক দিতে চেষ্টা করবো যাতে তোমরা ওই প্রতীকী ঘটনা লক্ষ্য করে একই সূত্রে ফেলে সঠিক উচ্চারণ নির্দেশ করতে পারো।
প্রতীক-১) অ+ই=ও (অর্থাৎ ই-কারের প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়)যেমন : অই (ওই), সই (সোই), খই (খোই), দই (দোই), হৈ হৈ (হোই হোই), রৈ রৈ (রোই, রোই), কড়ি (কোড়ি), মতি (মোতি), গতি (গোতি), রতি (রোতি), পতি (পোতি), অতি (ওতি), অহি (ওহি), ছবি (ছোবি), রবি (রোবি), পলি (পোলি), অস্থি (ওস্থি), কবিতা (কোবিতা), সবিতা (সোবিতা), কলিকাতা (কোলিকাতা), অধিক (ওধিক), অগ্নি (ওগ্নি), অর্চিত (র্ওচিতো), অছিলা (ওছিলা), জরিমা (জোরিমা), তনিমা (তোনিমা), অভিনয় (ওভিনয়্), অভিজাত (ওভিজাত্) ইত্যাদি।
প্রতীক-২) অ+ঈ = ও (অর্থাৎ ঈ-কারের প্রভাবে অ-কারটি ও এর মতো উচ্চারিত হয়) যেমন : নঈ (নোই), নদী (নোদি), সতী (সোতি), গভীর (গোভির), শরীর (শোরির), অতীত (ওতিত্), অধীন্ (ওধিন্), মণীষা (মোনিশা), রসবতী (রসোবোতি), গম্ভীর (গোর্ম্ভি), অভীপ্সা (ওভিপ্সা), অহীন্দ্র (ওহিন্দ্রো), পত্নী (পোত্নি) ইত্যাদি।
প্রতীক-৩) অ+উ = ও (অর্থাৎ উ-কারের প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়) যেমন : বউ (বোউ), মউ (মোউ), তবু (তোবু), কভু (কোভু), তরু (তোরু), বকুল (বোকুল), কবুল (কোবুল), অধুনা (ওধুনা), অযুত (ওজুত্), মধুর (মোর্ধু), কবুতর (কোবুর্ত), অনুভব (ওনুভব্), অনুমান (ওনুমান্), অনুশীলন (ওনুশিলন্), অনুকম্পা (ওনুকম্পা), অনুকরণ (ওনুকরন্) ইত্যাদি। 
প্রতীক-৪) অ+ঊ = ও (অর্থাৎ ঊ-কারের প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়) যেমন : বধূ (বোধু), ময়ূর (মোয়ুর), কটূক্তি (কোটুক্তি), করুন (কোরুন), মরূদ্যান (মোরুদ্দান), কর্পূর (র্কোর্পু), মসূর (মোশুর), অনূদিত (ওনুদিতো) ইত্যাদি।
প্রতীক-৫) অ+ঋ-কার = ও (অর্থাৎ ঋ-কারের প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়) যেমন : বক্তৃতা (বোক্তৃতা), যকৃত (জোকৃত্), কর্তৃত্ব (কোরতৃত্তো), কর্তৃপক্ষ (কোরতৃপখ্খো), কর্তৃকারক (র্কোতৃকারোক), ভতৃহরি (র্ভোতৃহরি), ভতৃহীনা (র্ভোতৃহিনা), মসৃণ (মোসৃন্) ইত্যাদি। 
প্রতীক-৬) অ+ক্ষ-কার = ও (অর্থাৎ ক্ষ-এর প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়) যেমন : লক্ষ (লোক্খো), কক্ষ (কোক্খো) দক্ষ (দোক্খো), পক্ষ (পোক্খো), রক্ষ (রোক্খো), যক্ষ (যোক্খো), অক্ষাংশ (ওক্খাংশ), অক্ষরেখা (ওক্খোরেখা), লক্ষণ (লোক্খোন), ভক্ষণ (ভোক্খোন), তক্ষক (তোক্খোক) ইত্যাদি।
প্রতীক-৭) অ+য-ফলা = ও (অর্থাৎ য-ফলার প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়) যেমন : অন্য (ওন্নো), জন্য (জোন্নো), ধন্য (ধোন্নো), গণ্য (গোন্নো), পণ্য (পোননো), নব্য (নোব্বো), সভ্য (শোভ্ভো), সত্য (সোত্তো), বন্য (বোন্নো), বন্যা (বোন্না), কন্যা (কোন্না), কল্যাণ (কোল্ল্যান), গব্যঘৃত (গোব্বোঘৃতো), তথ্য (তোত্থো), পথ্য (পোত্থো), অত্যন্ত (ওত্তোনতো) অধ্যক্ষ (ওদ্ধোক্খো), অত্যাচারিত (ওত্তাচারিতো) ইত্যাদি।
প্রতীক-৮) অ+জ্ঞ = ও (অর্থাৎ জ্ঞ প্রভাবে অ-কারটি ও-এর মতো উচ্চারিত হয়)যেমন : যজ্ঞ (যোগ্গো)
দেয়াল ঘেঁষা চেয়ারের উপর রাখা ব্ল্যাকবোর্ডে সূত্রের প্রতীক লিখে মুখে মুখে রসালো ভঙ্গিতে উদাহরণ দিয়ে যাচ্ছিলেন স্যার। 
দ্বিতীয় দফা চা পর্ব সারতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন স্যার। বোঝা গেল সূত্রের সরস আলোচনায় ক্ষ্যান্ত দিলেন আজ। তবে স্যারের এই ব্যাপারটি আমাদের মন কেড়েছে। সকলের সামনে নির্দ্বিধায় চা-পান পর্ব চালিয়ে যান নিরবে। স্তব্ধ ক্লাসের সকলে সে দৃশ্য উপভোগ করতে করতে ভাবি- সূত্রালোচনা না তাঁর খাওয়াপর্ব কোনটি শিল্প হয়ে উঠেছে? নাকি দুটোই।

ব্যতিক্রমও আছে (আদ্য অ)
পরের ক্লাসে কোন ভূমিকা না করে জিজ্ঞেস করলেন, অ-এর যে সূত্র দিয়েছিলাম, তা কি তোমরা আত্মস্থ করতে পেরেছো? সমস্বরে বলে উঠলাম, হ্যাঁ স্যার। আবার বললেন, শুধু ‘হ্যাঁ স্যার’ বললে চলবে না। চলনে বলনে ব্যবহার করতে হবে। যদি না লাগাও কাজে, তবে শ্রমও হবে বাজে, আর তোমরাও পড়বে লাজে। দাড়ি গোঁফের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে এলো উদার হাসি। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তেই উদাত্ত কণ্ঠে শুরু করলেন, সেদিন সূত্রের আলোচনার সময় নিয়মের বেলায় ‘সাধারণত’ শব্দটি বলেছিলাম। কিন্তু কিছু অসাধারণ জায়গা আছে, যেখানে সূত্রমতে উচ্চারিত হয় না। এজন্য ব্যতিক্রমও জানতে হয়। নাহলে অনেক সময় বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে। এবার সূত্রের ব্যতিক্রম সম্বন্ধে আলোচনা করবো।
ব্যতিক্রম-ক : শব্দের প্রথমে যদি না-বোধক বা নেতিবাচক ‘অ’ কিংবা ‘অন’ কিংবা সহিতর্থে ‘স’ থাকে তাহলে কোন অবস্থাতেই সেই ‘অ’ কিংবা ‘স’ ও-কারান্ত উচ্চারিত হবে না। এখানে ‘কোন অবস্থাতেই’ বলতে বোঝানো হচ্ছে, অ, অন, কিংবা স এর পর ই-কার, উ-কার, ক্ষ, জ্ঞ যাই আসুক না কেন ‘অ’ অবিকৃত থাকবে।
যেমন : অবিকৃত (অবিকৃতো), অবিচার (অবির্চা), অস্থির (অস্থির), অবিরাম (অবিরাম্), অবিনাশী (অবিনাশি), অনিয়ম (অনিয়ম্), অনিশ্চিত (অনিশ্চিতো), অসীম (অশিম্), অতুল (অতুল্), অনুপম (অনুপম্), অনুপস্থিত (অনুপোস্থিত), অমূল্য (অমুল্লো), অদৃষ্ট (অদৃশ্টো), অতৃপ্ত (অতৃপ্তো), অন্যায় (অন্ন্যায়), অব্যয় (অব্বয়), অটুট (অটুট্), অক্ষম (অক্খম্), অক্ষয় (অক্খয়্), অজ্ঞ (অগ্গোঁ), অজ্ঞান (অগ্গ্যাঁন), সঠিক (সঠিক্), সচিত্র (সচিত্ত্রো), সবিনয় (সবিনয়্), সসীম (শশীম্), সস্ত্রীক (শস্ত্রিক্), সতীর্থ (শতিরথো)।
এই পর্যন্ত ব্লাকবোর্ডে লিখে মুখে মুখে বলে গেলেন আবার। চেয়ারে বসে ধীরে সুস্থে সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এতক্ষণ যা বললাম, তা যদি তোমরা হৃদয়ঙ্গম করতে পারো, তাহলে আমি পরবর্তী ব্যতিক্রমের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। লীনা বসেছিল চুপ করে। অনেকটা ফস্ করে বলে ফেললো, স্যার, না-বোধক ‘অ’ যদি অবিকৃত থাকে, তাহলে অতুল প্রসাদের গানকে; ওতুল প্রসাদের গান বলা হয় কেন? শব্দময় আকর্ণ বিস্তৃত হাসি ছড়িয়ে পড়লো সারা ঘরে। কিছু না বুঝে আমরাও হেসে উঠলাম জোরে। স্যার বলতে শুরু করলেন, তোমাদের যে ব্যতিক্রমটির কথা বলতে চেয়েছিলাম, ওই মেয়েটি সে কথাই পেড়ে বসলো। সে যাকগে, এবার তোমরা চলো পরবর্তী ব্যতিক্রমে।
ব্যতিক্রম-খ : যেখানে কারো নাম বোঝায় সেখানে না-বোধক ‘অ’ কোথাও কোথাও ও-কারান্ত হতে পারে। যেমন ক্লাসের ওই সুদর্শনা মেয়েটি জিজ্ঞেস করেছে ওতুল প্রসাদের গান বলা হয় কেন? এখানে অতুলের স্থলে ওতুল বলা হচ্ছে যেহেতু ওটি একটি নাম। আমাদের দেশের সঙ্গীত শিল্পী ওজিত রায় (অজিত) কিংবা কবি ওসীম (অসীম) সাহার নাম নিশ্চয়ই শুনেছো। অথবা ওবিনাশ (অবিনাশ) দত্ত কিংবা ওনুপম (অনুপম) সেন নামে কাউকে ডাকতে শুনেছো। তবে নামের ক্ষেত্রে অ-যদিও ও-এর দিকে ঝুঁকে যায়, তবু অ-কারান্ত হলে ভালো হয়, তাতে নামের দিক থেকে অর্থগত অসুবিধা হয় না।
ব্যতিক্রম-গ : ইতোপূর্বে আমরা জেনেছি ক্ষ-থাকলে, তার আগের ‘অ’ ও-কারান্ত হয়। যেমন : রোগের লক্ষণ (লোক্খোন্) কিন্তু ক্ষ তে যদি ম-ফলা থাকে, তবে আগের ‘অ’ কোথাও অ-কারান্ত উচ্চারিত হয়। যেমন রামের ভাই লক্ষ্মণ (লক্খোঁন) একইভাবে পক্ষ্ম (পক্খোঁ), যক্ষ্মা (যক্খাঁ)।
অভ্যাসবশত বক্তৃতার সময় স্যার পায়চারী করেন। বক্তৃতার মাঝে মাঝে সাময়িক বিরতিকালে বা প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার সময় চেয়ারে বসে একটু বিশ্রাম নেন। কিন্তু কথা সে সময় থেমে থাকে না। বসে বসেই বলতে শুরু করলেন, এতক্ষণ আমরা সূত্র এবং ব্যতিক্রম আলোচনার মাধ্যমে অ-এর প্রথম বিধি অতিক্রম করলাম মাত্র। এরপর আমরা দ্বিতীয় বিধিতে যাব। আশা করি, প্রথম বিধির তুলনায় দ্বিতীয় বিধি সহজ মনে হবে তোমাদের কাছে।




শুদ্ধ উচ্চারণ বিষয়ক বক্তৃতা : আদ্য ‘অ’ এর অবশিষ্ট সূত্রাবলী - অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস

পর্ব : তিন

আদ্য ‘অ’ এর অবশিষ্ট সূত্রাবলী


আদ্য অ-এর দ্বিতীয় সূত্র : শব্দের প্রথমে যদি অ-কারান্ত বর্ণে র-ফলা যুক্ত হয়, তাহলে সাধারণত ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়। 
যেমন : প্রথম (প্রোথোম্), প্রভাত (প্রোভাত্), ব্রত (ব্রোতো), শ্রম (শ্রোম্), ভ্রমণ (ভ্রোমোন্), ভ্রমর (ভ্রোর্মো), দ্রষ্টা (দ্রোষ্টা), স্রষ্টা (স্রোষ্টা)।
ব্যতিক্রম : র-ফলা যুক্ত বর্ণটির পরে যদি ‘য়’ আসে, তাহলে কিন্তু অ-কার ঠিক থাকে। যেমন : ক্রয় (ক্রয়), ত্রয় (ত্রয়), আশ্রয় (আস্স্রয়)।
উঠে পায়চারী করতে করতে স্যার আবার শুরু করলেন কথা। এখন যে সূত্রটি আলোচিত হবে সেটি তোমাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য খুবই অপরিহার্য। এটি বাদ দিয়ে একটি দিনও তোমাদের চলবে না। সুতরাং এই সূত্রটির ব্যাপারে সচেতন থাকলে উচ্চারণের ক্ষেত্রে তোমরা বহু গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি সংশোধনের সুযোগ পাবে।



আদ্য অ-এর তৃতীয় সূত্র : সাধুভাষার পূর্ণাঙ্গ শব্দে কিংবা ক্রিয়াপদে ই-কার কিংবা উ-কার ছিল, চলিত ভাষার সংক্ষিপ্ত রূপে সেই ই-কার কিংবা উ-কার বিলুপ্ত হলেও তার আগের অ-কার প্রমিত উচ্চারণে ও-কারান্ত হয়ে থাকে। যেমন :
কলিকাতা থেকে কলকাতা (কোলকাতা)
হরিতকি থেকে হরতকি (হোরতোকি)
সজিনা থেকে সজনে (সোজনে)
ফড়িয়া থেকে ফড়ে (ফোড়ে)
বাড়িয়া থেকে বড়ে (বোড়ে)
ধরিয়া থেকে ধরে (ধোরে)
মরিয়া থেকে মরে (মোরে)
সরিয়া থেকে সরে (সোরে)
ধসিয়া থেকে ধসে (ধোসে)
পচিয়া থেকে পচে (পোচে)
গলিয়া থেকে গলে (গোলে)
পড়িয়া থেকে পড়ে (পোড়ে)
করিয়া থেকে করে (কোরে)
বসিয়া থেকে বসে (বোসে)
করিবে থেকে করবে (র্কোবে)
চলিবে থেকে চলবে (চোল্বে)
মরিবার থেকে মরবার (মোরবার)
ধরিবার থেকে ধরবার (ধোরবার)
একঘরিয়া থেকে একঘরে (এ্যাক্ঘোরে)
হলুদিয়া থেকে হলদে (হোল্দে)



এদিক ওদিক তাকিয়ে সামনে পেয়ে গেলেন জহিরকে। আঙুল তুলে প্রশ্ন করে বসলেন, আগের ক্লাসে আদ্য-অ এর তৃতীয় সূত্র আলোচনা করেছিলাম। জহির, তুমি বলোতো-সূত্রটি। জহির আম্তা আম্তা করে মাথা চুলকে বললো, চলিত ভাষার সংক্ষিপ্ত রূপে ই-কার বিলুপ্ত হলেও আগের অ-কার ও-কারান্ত হয়। দাড়ি গোঁফের ফাঁক গলিয়ে হাসি ফুটে উঠলো। চেয়ারে বসে চোখ বুজে জাবর-কাটার ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলেন, কিন্তু সব জায়গাতে এই নিয়ম খাটবে না। এর ব্যতিক্রমও আছে। যেমন :
রইবে থেকে রোবে নয়, রবে
লইবে থেকে লোবে নয়, লবে
সইবে থেকে সোবে নয়, সবে
বইবে থেকে বোবে নয়, ববে
কইবে থেকে কোবে নয়, কবে
হইবে থেকে হোবে নয়, হবে।
কাকলি বললো, স্যার, এগুলো ছাড়া আর কোথাও ব্যতিক্রম ঘটবে না? চোখ মেলে তাকিয়ে স্থির দৃষ্টিতে বললেন, আরো কিছু থাকতেও পারে। তোমরা একটু খোঁজ করে দেখে নিও। সে যাকগে, এবারে নতুন নিয়ম বা সূত্রে প্রবেশ করছি।



আদ্য অ-এর চতুর্থ সূত্র : ১৯৩৬ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতির এক নম্বর নিয়মে বলা হলো, রেফ এর পর ব্যঞ্জনে কোন দ্বিত্ব হবে না। সুতরাং য-রেফ এর পর য-ফলা উঠে গেল। যেমন :
পর্য্যন্ত হয়ে গেল পর্যন্ত
কার্য্যালয় হয়ে গেল কার্যালয়
সূর্য্য হয়ে গেল সূর্য
বানান সংস্কার করা হলেও, উচ্চারণে কোন পরিবর্তন আনা হলো না। ফলে পূর্বের উচ্চারণটি অবিকৃত থেকেই গেল। কয়েকটি উদাহরণ দিলেই কিন্তু ব্যাপারটি তোমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
মূল বানান বর্তমান বানান উচ্চারণ
পর্য্যন্ত পর্যন্ত পোরজোনতো
পর্য্যায় পর্যায় পোরজায়
পর্য্যটন পর্যটন পোরজোটোন
পর্য্যালোচনা পর্যালোচনা পোরজালোচনা
পর্য্যবেক্ষণ পর্যবেক্ষণ পোরজোবেক্খোন 
মর্য্যাদা মর্যাদা মোরজাদা
চর্য্যাপদ চর্যাপদ চোরজাপদ



পায়চারী করতে করতে গলা চড়িয়ে দিলেন। এবারে আদ্য-অ এর পঞ্চম সূত্র সম্পর্কে বলবো। যদিও এটিকে ঠিক সূত্র বলা যাবে না, তবুও আমরা একটু নিয়মে ফেলে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করবো।



আদ্য অ-এর পঞ্চম সূত্র : একাক্ষর বা এক অক্ষর বিশিষ্ট শব্দের শেষে যদি ‘ন’ থাকে, তাহলে সাধারণত পূর্বের অ-এর উচ্চারণ ও-কারান্ত হয়।
যেমন : মন (মোন), বন (বোন), জন (জোন) তবে বাংলাদেশে ধন উচ্চারণের ক্ষেত্রে ধোন্ না বলে ধন্ (অ-অবিকৃত) বলা হয় এবং জন এর ক্ষেত্রেও জোন না বলে জন্ (অ-অবিকৃত) বলা হয়ে থাকে। আবার যদি একাক্ষর শব্দের শেষে ন-এর পরিবর্তে ণ থাকে, তাহলে পূর্বের অ-টিকে অবিকৃত রেখে অ-কারান্ত উচ্চারণ করা হয়। যেমন- পণ, মণ, রণ, ক্ষণ ইত্যাদি।
একটানা পায়চারী করতে করতে কথাগুলি বলে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন স্যার। ডানগালের ভিতর পুরে রাখা ডাবল পানে জোরে জোরে কামড় দিতেই মুচমুচ শব্দের সাথে ঠোঁট রাঙা হয়ে উঠলো।
পানের রসে ভিজে থাকা গোঁফের অগ্রভাগ ডানহাতের উল্টোপিঠে মুছে নিলেন ধীরে ধীরে। চলতে চলতে আবার বলতে লাগলেন, এই একাক্ষরবিশিষ্ট শব্দগুলি যখন অন্য শব্দের সঙ্গে সন্ধির সূত্রে আবদ্ধ হয় কিংবা অন্য পদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সমাসবদ্ধ হয়, তখন কিন্তু তার আসল উচ্চারণ অর্থাৎ অ-কারান্ত উচ্চারণের রূপেই ফিরে আসে। 
যেমন- 
মনান্তর-মনান্তর
মনোহর-মনোহর
মনোলোভা-মনোলোভা
মনোতোষিনী-মনোতোষিনি
মনোবিজ্ঞান-মনোবিগ্গাঁন
বনবাসী-বনোবাসি
বনমালী-বনোমালি
বনান্তর-বনান্তর
বনস্পতি-বনোশ্পোতি
ধনপতি-ধনোপোতি
ধনোহারী-ধনোহারি
ধনধান্য-ধনোধান্নো



আমাদের আদ্য-অ এর সূত্রের আলোচনা এখানেই শেষ হলো। তবে এই সূত্র বা নিয়মকে একমাত্র নিয়ম বা চিরাচরিত নিয়ম মনে করা উচিত নয়। কারণ মানুষের মুখের ভাষা বহমান, তা অনেক সময় পরিবর্তন হয় বলেই উচ্চারণের অনেক বিধিই পরিবর্তন হয়ে যায়। ব্যাকরণ আলোচনা, ধ্বনিতত্ত্ব আলোচনা বা ভাষাতাত্ত্বিক বিধান যতই দেয়া হোক না কেন, মানুষের মুখের ভাষার বহমানতাই হচ্ছে এর মূল নিয়ন্ত্রক।




শুদ্ধ উচ্চারণ বিষয়ক বক্তৃতা : মধ্য ‘অ’ এর সূত্র - অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস

পর্ব : চার  
এবার মধ্য - অ এর সূত্রাবলী অনেকদিন পর স্যারকে আজ বেশ ফ্রেশ দেখাচ্ছে। চুল-দাড়ি ছোট করে ছেঁটে পাঞ্জাবীর বদলে হাফ শার্ট পরে ফিটফাট হয়ে এসেছেন। কাঁধের ঝোলাটিও উধাও। তবে পায়ের স্যাণ্ডেল আগেরটিই আছে।গাম্ভীর্য ভেদ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কোমল হাসি সারা মুখমণ্ডলে। চেয়ারে বসে থেকেই বলতে শুরু করলেন, আদ্য-অ-এর পর আজ আলোচনা করবো মধ্য-অ- এর সূত্র। নড়েচড়ে বসলাম। উচ্চারণ সম্পর্কে যে ভীতি ছিল, তা কেটে গেছে কবে। এখন উচ্চারণের সূত্র শুনতে শুনতে মজার নেশায় পেয়ে বসেছে যেন। আদ্য-অ-এর নিয়মকানুন ঠোঁটের আগে ঝুলে থাকছে সবসময়। একজন আরেকজনকে উচ্চারণ দিয়ে ঠকানোর খেলা জমে উঠেছে এই ক’দিনে। স্যার গলা চড়ালেন আরো একটু। এখন যেটি আলোচনা করবো, তাকে তোমরা মূল সূত্র না বলে প্রাসঙ্গিক সূত্র বলতে পারো। এই সূত্রটি হলো : যে সকল কারণে শব্দের আদ্য-অ, ও-কারন্ত উচ্চারিত হয়, তার সবগুলি সূত্রই মধ্য-অ এর ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন- ই-কার আদ্য-অ-এর ক্ষেত্রে মতি (মোতি) মধ্য-অ-এর ক্ষেত্রে সুমতি (সুমোতি) দুর্মতি (র্দুমোতি) অগতি (অগোতি) প্রগতি (প্রোগোতি) কুমতি (কুমোতি) উ-কার/ঊ-কার/ঋ-কার আদ্য-অ-এর ক্ষেত্রে তনু (তোনু) ময়ুর (মোয়ুর) মধ্য-অ-এর ক্ষেত্রে সুতনু (সুতোনু) সুমধু (সুমোধু) পথতরু (পথোতোরু) পুত্রবধু (পুত্ত্রোবোধু) মনময়ুর (মনমোয়ুর) সুমসৃন (সুমোস্সৃন) অমসৃন (অমোস্সৃন) ঈ-কার আদ্য-অ-এর ক্ষেত্রে ননী (নোনি) মধ্য-অ-এর ক্ষেত্রে জননী (জনোনি) ধরনী (ধরোনি) সরণী (সরোনি) বরনী (বরোনি) ঘরনী (ঘরোনি) য-ফলা বিলুপ্ত আদ্য-অ-এর ক্ষেত্রে পর্যায় (র্পোযায়) মধ্য-অ-এর ক্ষেত্রে আশ্চর্য (আশ্চোরযো) ঐশ্বর্য (ঐর্শোযো) সৌন্দর্য (সৌর্ন্দোযো) সুমি চুপচাপ বসে স্যারের বক্তৃতা শুনতে অভ্যস্ত। কোনদিন একটি কথাও বলে না। সেজন্য কারও নজরে পড়েনি সে। আমরাও তাকে খুব একটা খেয়াল করিনি কোনদিন। আজ দুম্ করে প্রশ্ন করলো, স্যার, আদ্য-অ-এর সূত্র অনুযায়ী মধ্য-অ তেও একই নিয়ম প্রযোজ্য হলে আলাদাভাবে আলোচনা করার আর দরকার কি? বললেই হতো, আদ্য, মধ্য এবং অন্ত সকল অ-এর ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য। আলাদা আর কোন সূত্র নেই। স্যার একটু থমকে গেলেন। পর মুহূর্তেই খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন, এই মেয়ে, বোকার মতো কথা বলোনাতো! তোমাকে কে বলেছে, মধ্য-অ-এর ক্ষেত্রে কোন মৌলিক সূত্র নেই? এর পরইতো সেই আলোচনায় আসব। সুমি এদিক ওদিক তাকিয়ে চুপ্সে গেল একটু। কোন কথা না বলে হাবার মতো চুপচাপ তাকিয়ে থাকলো স্যারের দিকে। একটু মায়ামাখা সুরে স্যার বললেন, সে যাকগ্, এবার আমরা মধ্য-অ-এর মৌলিক সূত্র আলোচনা করবো। সূত্র : এক তিনবর্ণে গঠিত শব্দের প্রথম বর্ণটি যদি অ-কারান্ত, আ-কারান্ত, এ-কারান্ত কিংবা ও-কারান্ত হয়, তাহলে মাঝখানের অ-কারান্ত বর্ণটি সাধারণত ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, শর্ত চারটি হলো : অ-কারান্ত, আ-কারান্ত, এ-কারান্ত, ও-কারান্ত। আদ্য বর্ণ অ-কারান্ত অমন (অমোন্) গঠন (গঠোন্) যখন (যখোন্) তখন (তখোন্) পঠন (পঠোন্) ফসল (ফসোল্) ফলন (ফলোন্) কলম (কলোম্) মশক (মশোক্) দলন (দলোন্) মলন (মলোন্) শতক (শতোক্) যতন (যতোন্) রতন (রতোন্) আদ্য বর্ণ আ-কারান্ত আমন (আমোন্) কাজল (কাজোল্) আসল (আসোল্) কাগজ (কাগোজ্) পাগল (পাগোল্) ছাগল (ছাগোল্) জাগর (জার্গো) নাগর (নার্গো) সাগর (সার্গো) আসন (আসোন্) বাসন (বাসোন্) আদ্য বর্ণ এ-কারান্ত চেতন (চেতোন্) বেতন (বেতোন্) কেতন (কেতোন্) লেহন (লেহোন্) শেখর (শের্খ) কেশর (কের্শো) আদ্য বর্ণ ও-কারান্ত ওজন (ওজোন্) ভোজন (ভোজোন্) শোধন (শোধোন্) বোধন (বোধোন্) তোষণ (তোষোন্) লোচন (লোচোন্) রোচন (রোচোন্) দীপু বরাবরই বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করে, আজকেও সুযোগ নিল। ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, স্যার, এই নিয়মগুলো কি সবক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, নাকি কোন ব্যতিক্রমও আছে? চোখ বন্ধ করে পান চিবোতে শুরু করেছিলেন স্যার। যেন ঘুম থেকে উঠলেন, এমনভাবে চোখ মেলে চাইলেন দীপুর দিকে। পান চিবোতে চিবোতে বলতে লাগলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ দীপু ঠিক সময়ে প্রশ্নটি করে আমাকে বাঁচিয়েছে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কোথায় ব্যতিক্রম হয়, সে ব্যাপারটি তোমরা এবার লিখে নাও। তিনবর্ণে গঠিত শব্দের প্রথম বর্ণটি যদি না বোধক অ-হয়, কিংবা সহিত অর্থে স-হয়, তাহলে মাঝখানের অ-কারান্ত বর্ণটি ও-কারান্ত উচ্চারিত না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যেমন : অচল (অচল্) অজর (অর্জ) অমর (অর্ম) অমল (অমল্) অবশ (অবশ্) অবলা (অবলা) সরস্ (সরস্) সরব (সরব্) সফল (সফল্) সজল (সজল্) অটল (অটল্) অচল (অচল্) সুমন ঢুকলো গরম চায়ের গ্লাস হাতে। সেদিকে স্নিগ্ধ দৃষ্টি মেলে তৃপ্তির হাসি দিলেন স্যার ছোট্ট করে। চায়ের গ্লাসে সশব্দে চুমুক দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আবার। গ্লাস হাতে হাঁটতে হাঁটতে মধ্য -অ-এর দ্বিতীয় ও শেষ সূত্র লেখার নির্দেশ দিয়ে বলতে শুরু করলেন। সূত্র : দুই একাধিক সংস্কৃত শব্দ বা তৎসম শব্দ সমাসবদ্ধ পদে পরিণত হলে, পূর্বপদের শেষের অ-কারান্ত বর্ণটি ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়। যেমন : পথ (পথ্) থেকে পথচারী (পথোচারি) মেঘ (মেঘ্) থেকে মেঘমালা (মেঘোমালা) জল (জল্) থেকে জলচর (জলোচর) শ্রম (শ্রম্) থেকে শ্রমমন্ত্রী (শ্রমোমোন্ত্রি) বন (বন্) থেকে বনভূমি (বনোভুমি), বনচারী (বনোচারি), বনবাসী (বনোবাসি) লোক (লোক্) থেকে লোকসাহিত্য (লোকোসাহিত্ত্য) গণ (গণ্) থেকে গণব্যবহার (গনোব্যবহার), গণনাট্য (গনোনাট্ট্য), গণনায়ক (গনোনায়ক্) চায়ের গ্লাসটি হাত থেকে চেয়ারের উপরে রেখে পাশের খালি চেয়ারটিতে ধপ্ করে বসে পড়লেন। দীপুর দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে রহস্যময় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, এবারো কিন্তু ব্যতিক্রম আছে। যেমন : রাজ (রাজ্) থেকে রাজহংস (রাজহংসো), রাজহাঁস (রাজহাঁস), রাজকন্যা (রাজকননা), রাম (রাম্) থেকে রামচন্দ্র (রামচন্দ্রো)


শুদ্ধ উচ্চারণ বিষয়ক বক্তৃতা : অন্ত্য ‘অ’ এর সূত্র - অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস

পর্ব : পাঁচ


শুরু হলো অন্ত্য-অ



গত সপ্তাহে হঠাৎ করে অচেতন হয়ে যাওয়ায় স্যারকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল। উচ্চারণের ক্লাসটি আর হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ ছিল বেশ। কিন্তু এক সপ্তাহেই ফিরে আসবেন তা ভাবতে পারে নি কেউ। অন্য দিনের মতো চটপটে ভাব না থাকলেও গলার জোর কমে নি স্যারের। ‘চলা’ ধীর হলেও ‘গলা’ এবং ‘বলা’র দাপট আছে আগের মতোই। চেয়ারে বসে থেকেই হাঁক দিলেন, আদ্য-অ এবং মধ্য-অ এর পর এবার আমরা অন্ত্য-অ-এর সূত্র আলোচনা করবো। লেখ তোমরা :
প্রথম সূত্র : শব্দের শেষে যদি অ-কারান্ত যুক্ত ব্যঞ্জনবর্ণ থাকে তা হলে তার প্রথমটি হসন্ত এবং দ্বিতীয়টি সাধারণত: ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়।যেমন-
যুক্ত - যুক্ + তো - যুক্তো
শক্ত - শক্ + তো - শক্তো
ভক্ত - ভক্ + তো - ভক্তো
রক্ত - রক্ + তো - রক্তো
যত্র - যত + ত্রো - যত্ত্রো
তত্র - তত্ + ত্রো - তত্ত্রো
পত্র - পত্ + ত্রো - পত্ত্রো
মাত্র - মাত্ + ত্রো - মাত্ত্রো
গঞ্জ - গন্ + জো - গন্জো
কক্স - কক্ + সো - কক্সো
ভণ্ড - ভন্ + ডো - ভন্ডো
অভ্যাসবশত একটু উঠে দাঁড়ালেন। আগের মতো শরীরে জোর না থাকায় পায়চারী করার চেষ্টা করেও হাঁটতে পারলেন না। চেষ্টা আর না বাড়িয়ে বলতে শুরু করলেন দ্বিতীয় সূত্র।
দ্বিতীয় সূত্র : ত কিংবা ইত প্রত্যয়যোগে গঠিত শব্দে অন্তিম-অ রক্ষিত এবং ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়ে থাকে। যেমন :
নত - নতো
গত - গতো
মত - মতো
যত - যতো
তত - ততো
শতশত - শতোশতো
গঠিত - গোঠিতো
রক্ষিত - রোক্খিতো
পালিত - পালিতো
দিক্ষিত - দিক্খিতো
মোহিত - মোহিতো
লোলিত - লোলিতো
নিশ্চিত - নিশ্চিতো
নির্মিত - নির্মিতো
মৌসুমীর মাঝে মাঝে ফোড়ন কাটার অভ্যাস আছে। ফট্ করে বলে ফেললো স্যার, আমরা তাহলে এখন থেকে ভাত্কে ভাতো, হাত্কে হাতো বলবো? দুম্ করে বোমা ফাটার মতো হাসিতে ফেটে পড়লো ক্লাসশুদ্ধ সবাই। কোনরকম অপ্রস্তুত না হয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে চললেন স্যার, যে সকল শব্দ বিশেষ্য রূপে ব্যবহৃত হয়, সে সকল শব্দে সাধারণত হসন্ত উচ্চারিত হয়। তাছাড়া মানুষের মুখের ভাষার ব্যবহারে কতকগুলো শব্দের উচ্চারণ বদল হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় :
হাত - হাত্
ভাত - ভাত্
অতীত - ওতিত্
উচিত - উচিত্
মৌসুমী এখনো হাল ছাড়ে নি। আগের মতো উদ্ধত ভঙ্গিতে বলে উঠলো, স্যার আপনি বললেন মোহিত উচ্চারণ মোহিতো হবে। কিন্তু আমরা তো কবি মোহিত লাল মজুমদারকে কখনো মোহিতো লাল মজুমদার বলি না। এবার আর কেউ হাসলো না। প্রশ্নটা খুবই সিরিয়াস ভেবেই বোধহয় চুপ করে থাকলো সকলে। কেউ না হাসলেও স্যারের মুখভর্তি হাসি ছড়িয়ে পড়লো। মৌসুমীর দিকে তর্জনী উঁচু করে বোঝাতে শুরু করলেন, তোমার জিজ্ঞাসাকে কটাক্ষ না করে সহজ ভাষায় প্রশমিত করার চেষ্টা করা দরকার। আমি আগে কোথাও কোথাও যেমনটি বলেছি, বিশেষ্য বা নামের ক্ষেত্রে এখানেও ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এ ক্ষেত্রে নাম বা পদবী হলে সাধারণত অন্তিম-অ টি হসন্ত উচ্চারিত হয়। যেমন :
রনজিত রক্ষিত - রোক্খিত্
মাধুরী দিক্ষিত - দিক্খিত্
আনন্দচন্দ্র পালিত - পালিত্
লোলিত মোহন নাথ - লোলিত্
মোহিত লাল মজুমদার - মোহিত্
শম্পা খুব সহজ সরল। ওর প্রশ্ন করার ধরণটাও বেশ সাধারণ। স্যার একটু থামতেই উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমরা নিশ্চিত্ বলবো না নিশ্চিতো বলবো? শম্পার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে স্যার বলতে লাগলেন, সূত্রমতে আমরা এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত কে নিশ্চিতোই বলবো। কিন্তু এখন অনেকেই নিশ্চিত্ বলছেন দ্বিধাহীন চিত্তে। হয়তো এমন একদিন আসবে, যখন মুখের ভাষার গতিময়তো নিশ্চিতো কে নিশ্চিত্, স্থগিতো কে স্থগিত্ করে ফেলবে। তখন আমাদের মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না।
এতক্ষণে লিকার চায়ের প্রতি স্যারের তৃষ্ণা তুঙ্গে উঠেছে। কিন্তু রইস এখনো চা নিয়ে ঢুকছে না দেখে বেশ জোরে হাঁক দিলেন। দরজার বাইরে থেকে রইসের লাজনম্র মুখখানা ভিতরে চলে এলো। হাতের ইশারায় স্যারকে আশ্বস্ত করে দ্রুত বেরিয়ে গেল আবার। যেন কিছুই ঘটেনি এমনভাবে বলতে লাগলেন ফের।
তৃতীয় সূত্র : বাঙলা ভাষাতে এমন কিছু শব্দ রয়েছে যেগুলি বিশেষ্যরূপে ব্যবহৃত হওয়ার সময় হসন্ত উচ্চারিত হয়, কিন্তু বিশেষণ রূপে ব্যবহৃত হওয়ার সময় ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়।
বিশেষ্য
ভাল (কপাল) - ভাল্
কাল (সময়) - কাল্
বিশেষণ
ভাল (উত্তম) - ভালো
কাল (রঙ) - কালো
চতুর্থ সূত্র : বিশেষ্যবাচক শব্দের শেষে ‘হ’ এবং বিশেষণবাচক শব্দের শেষে ‘ঢ়’ থাকলে সাধারণত ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়। যেমন :
বিবাহ - বিবাহো গাঢ় (গাঢ়ো)
কলহ - কলোহো দৃঢ় (দৃঢ়ো)
বিরহ -বিরহো মূঢ় (মুঢ়ো)
গ্রহ - গ্রোহো প্রগাঢ় (প্রোগাঢ়ো)
স্নেহ - স্নেহো দেহ - দেহো
মৌসুমী মনে হয় এখনো শান্ত হতে পারে নি। আবারো সুযোগ পেয়ে ফস্ করে বলে ফেললো, স্যার তাহলে আষাঢ়কে আষাঢ়ো বলতে হবে? এবারে স্যার বেশ বিরক্ত হলেন। গলা দিয়ে গাঁক করে শব্দ বেরিয়ে এলো। বিব্রত মৌসুমীকে আরো চটানোর জন্য দীপু পেছন থেকে সহানুভূতির ছলে চুক্ চুক্ শব্দ করতেই ধপাস করে বসে পড়লো মৌসুমী। ধীরলয়ে স্যার বলতে লাগলেন, বিশেষণ বাচক শব্দের শেষে ‘ঢ়’ থাকলে ও-কারান্ত উচ্চারণ করতে হয়। কিন্তু আষাঢ় বিশেষণবাচক নয়, বিশেষ্যবাচক শব্দ। তাই এক্ষেত্রে আষাঢ়কে আষাঢ় বলা হয়। একগ্লাস লাল চা, বাটিতে ছোলামুড়ি ও দুটো সবরি কলা নিয়ে রইস পাশের চেয়ারে রাখলো। ক্লান্ত যতীন স্যার বসে পড়লেন চেয়ারে। রইসের দিকে সস্নেহ দৃষ্টি মেলে মৃদু ধন্যবাদ দিলেন যেন।



অন্ত্য-অ-এর শেষ সূত্র



ভিতরে ঢুকেই হাঁক দিলেন, জহির, তুমি বলোতো, অন্ত্য-অ-এর সূত্র শেষ হয়েছে কি না? প্রশ্নের ধরণ বুঝতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো জহির। শম্পা খুবই সপ্রতিভ। জহিরকে রক্ষা করার জন্য চট্ করে বলে ফেললো, স্যার, অন্ত্য-অ-এর চারটি সূত্র বলা হয়েছিল। আমার মনে হয়, আরো কয়েকটি সূত্র বাকী রয়েছে। শম্পার কথায় স্যার বেশ খুশী হলেন মনে হলো । ওর কথা লুফে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এবারে অন্ত্য-অ-এর পরবর্তী সূত্র।
পঞ্চম সূত্র : বাঙলা ভাষার যে সকল শব্দের বানানে বিসর্গ ছিল, কিন্তু বর্তমান বানানে বিসর্গ বিলুপ্ত হয়েছে, সেসকল শব্দের উচ্চারণ সাধারণত ও-কারান্ত হয়। যেমন :-
প্রথমত - প্রোথমত (প্রোথোমতো)
বস্তুত - বস্তুত (বোস্তুতো)
দ্বিতীয়ত - দ্বিতীয়ত (দিতিয়তো)
সতত -সতত (সততো)
প্রণত - প্রণত (প্রনতো)
প্রায়শ - প্রায়শ (প্রায়শো)
পায়চারী বন্ধ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। মিনিট খানেক পরে ক্লাসরুমের স্তব্ধতা ভেদ করে গমগমে স্বরে বলে উঠলেন পুনরায়, পাঁচ নম্বর সূত্রের পর ছয় নম্বর সূত্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছি আমরা। এর মধ্যে তোমাদের মনে কোনো প্রশ্ন জেগে থাকলে বলতে পারো। মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করে কোনো উত্তর পেলেন না স্যার। হাসিমুখে উঠে দাঁড়ালেন আবার। হাঁটতে হাঁটতে শুরু করলেন পরবর্তী সূত্র।
ষষ্ঠ সূত্র : বাঙলা ভাষায় ‘তর’ এবং ‘তম’ প্রত্যয়যোগে গঠিত শব্দে শেষের ‘অ’ সাধারণত রক্ষিত থাকে এবং ও-কার উচ্চারিত হয়। যেমন :
উচ্চতর - উচ্চোতরো
উচ্চতম - উচ্চোতমো
অধিকতর - অধিকোতরো
গভীরতর - গভিরোতরো
বৃহত্তম - বৃহত্তমো
ক্ষুদ্রতর - ক্ষুদ্দ্রতরো
ক্ষুদ্রতম - ক্ষুদ্দ্রতমো
শম্পা আবার উঠে দাঁড়ালো। দু-হাত বুকের কাছে উঠিয়ে খুব আস্থার সাথে উচ্চারণ করলো, স্যার, তাহলে আমরা এখন থেকে উত্তমকে উত্তমো বলবো। যতীন স্যার কিন্তু মোটেই রাগ করলেন না। সবার হাসির হুল্লোড়ের মাঝে গলা চড়িয়ে বললেন, শম্পার কথায় হাসির কিছু নাই।
ও, সরলভাবে সূত্র অনুসরণ করে কথাটি বলে ফেলেছে। তাতে ওর কোনো দোষ দেখি না। মূল ব্যাপারটি হচ্ছে, এটি একটি ব্যতিক্রম। উত্তম-এর উচ্চারণ হবে উত্তম্। সে যাকগে, এবারে আমরা সপ্তম ও শেষ সূত্রে প্রবেশ করবো।
সপ্তম সূত্র : ঙ, ং, ঋ-কার, ঐ-কার, ঔ-কার এর পরে অ-কারান্ত বর্ণ থাকলে সাধারণত শেষের বর্ণটি ও-কারান্ত উচ্চারিত হয়। যেমন-
ঙ : 
অঙ্ক - অঙ্কো
বঙ্ক - বঙ্কো
শঙ্খ - শঙ্খো
ং : 
অংশ - অংশো
বংশ - বংশো
ধ্বংশ - ধ্বংশো
কংশ - কংশো
ঋ-কার : 
কৃশ - কৃশো
বৃষ - বৃশো
তৃণ - তৃনো
নৃপ - নৃপো
মৃগ - মৃগো
ঐ-কার : 
দৈব - দোইবো
শৈব - শোইবো
স্ত্রৈণ - স্ত্রোইনো
জৈন - জোইনো
কৈল - কোইলো
হৈল - হোইলো
তৈল - তোইলো
ঔ-কার :
গৌণ - গোও্নো
মৌন - মোও্নো
ধৌত - ধোও্তো
ভৌত - ভোও্তো
ভৌম - ভোও্মো
পৌর - পোওরো
সৌর - সোওরো
গৌর - গোওরো
একটানা এতগুলো নিয়ম বলতে বলতে স্যার হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। স্যারেরতো শুধু বলা নয়। বলার সঙ্গে চলাও বাদ যায় না। বলা চলা আর গলা এই তিন নিয়েইতো স্যারের আসল কলা। চেয়ারে বসে পড়লেন ধপ্ করে। চা ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। আধঘন্টা আগে দিয়ে যাওয়া চা গরম থাকে কি করে? ঠাণ্ডা চায়ে মুখ দিয়ে একটু বিকৃত হলো স্যারের মুখ। তারপর সামলে নিয়ে পরম তৃপ্তিভরে লম্বা চুমুক দিয়ে গ্লাসের অর্ধেক চা শেষ করে ফেললেন।
শম্পার যেন আজ কি হয়েছে। বারবার উঠে দাঁড়ানোর প্রবণতা আবার তাকে পেয়ে বসলো। স্যারের নিরবতার সুযোগে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো, স্যার, এক্ষেত্রে কোন ব্যতিক্রম নেই? সাথে সাথে কোন উত্তর না দিয়ে হাফপ্লেটে পড়ে থাকা ডাবল্ পান মুখে পুরে কুচমুচ শব্দ তুলে সামনে তাকালেন। হা করে হাতের তালু থেকে বাবাজর্দার দলা মুখের ভিতর ছুঁড়ে দিলেন। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা শম্পাকে হাতের ইশারায় বসতে বলে উঠে দাঁড়ালেন। হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ব্যতিক্রমতো অবশ্যই আছে। যেমন :
খৈল - খইল্
দৌড় - দোউড়্
পৌষ - পোউষ্
গৌড় - গোউড়্

হঠাৎ পেছন ফিরে চেয়ারের পাশে পড়ে থাকা কাপড়ের ঝোলাটা কাঁধে তুলে নিলেন। ঝট্ করে ঘুরেই চলতে লাগলেন দরজার দিকে। কেউ কিছু বললো কি না সে ব্যাপারে ভাবার কোন প্রয়োজন বোধ করলেন না স্যার।


শুদ্ধ উচ্চারণ বিষয়ক বক্তৃতা : এ কোথায় অ্যা এর সূত্র - অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস

পর্ব : ৬

এ কোথায় অ্যা



আজকে নাতিদীর্ঘ সরস বক্তৃতার ঢেউ না তুলে ভূমিকাপর্বটি একটু পাল্টে ফেললেন যতীন স্যার। একবার জোরে ‘এ’ বলোতো। পেটের থেকে আওয়াজ বেরিয়ে দেওয়ালে মেঝেতে ধাক্কা খেয়ে কেঁপে উঠলো ঘর। দাড়িগোঁফের ফাঁক গলিয়ে খুশীর ঝিলিক ছড়িয়ে পড়লো স্যারের মুখে। সেটা ধরে রেখেই বললেন, এবার তোমরা ‘অ্যা’ বলোতো ওরকম জোরের সাথে। মূহুর্তে সারা ঘর প্রকম্পিত হলো ‘অ্যা’ ধ্বনিতে।
নাক কুঁচ্কে প্রশ্ন করলেন, তোমরা কয়টি বর্ণ উচ্চারণ করলে বলতে পারবে? ফস্ করে মিনা বলে উঠলো, স্যার দুটো বর্ণ। হেসে ফেললো অনেকেই। জহির কুণ্ঠাভরে বললো, না স্যার, বর্ণ একটিই। তবে ধ্বনি দুটো। একবার ‘এ’-এর মতো করে আরেকবার ‘অ্যা’-এর মতো উচ্চারণ করলো। খুব খুশী হলেন স্যার। সামনে এগিয়ে এসে জহিরের পিঠ চাপ্ড়ে বলতে লাগলেন, বাঙলা স্বরবর্ণে ‘এ’ নামে একটিমাত্র স্বরবর্ণ আছে। কিন্তু তার দুটি উচ্চারিত রূপ আছে। কোথাও ‘এ’ বর্ণটি ‘এ’-এর মতোই অবিকৃত উচ্চারণ হয়। কিন্তু কোথাও কোথাও ‘অ্যা’-এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন : এক (অ্যাক) কিন্তু একটি (এক্টি)। এজন্য ‘এ’ এর উচ্চারণের ব্যাপারে প্রায়শই বিভ্রান্তি দেখা দেয়। ‘অ্যা’ আমাদের উচ্চারণে আছে, বচনে আছে, কথায় আছে, কিন্তু লেখায় নেই। তাই সমস্যা থাকবেই, তবে ‘এ’-এর উচ্চারণের বিষয়ে পাকাপোক্ত কোন বিধি বা নিয়ম আমাদের জানা নেই। কিন্তু বোঝার সুবিধার জন্য প্রাথমিকভাবে কিছু সাধারণ সূত্র বা নিয়ম আমরা দাঁড় করাতে পারি।



সূত্র এক : এ-কারের পরে যদি ই-কার, উ-কার কিংবা এ-কার থাকে, তাহলে সাধারণত পূর্বের এ-কার বিকৃত হয় না বা অ্যা-কার রূপে উচ্চারিত হয় না। যেমন 
খেলা (খ্যালা) কিন্তু খেলি (খেলি)
বেলা (ব্যালা) কিন্তু বেলি (বেলি)
ঠেলা (ঠ্যালা) কিন্তু ঠেলি (ঠেলি)
দেখ (দ্যাখ) কিন্তু দেখি (দেখি)
দেখা (দ্যাখা) কিন্তু দেখুন (দেখুন)
এক (অ্যাক্) কিন্তু একটি (এক্টি)
একটা (অ্যাক্টা) কিন্তু একটু (একটু)
টেংরা (ট্যাংরা) কিন্তু টেংরি (টেংরি)
লেংড়া (ল্যাংড়া) কিন্তু লেংড়ি (লেংড়ি)
ভেংচানো (ভ্যাংচানো) কিন্তু ভেংচি (ভেংচি)
গেছে (গ্যাছে) কিন্তু গেছি (গেছি)
একটানা উদাহরণগুলো বলে একটা পান মুখে দিলেন স্যার। চোখ-বন্ধ করে চুক্ চুক্ শব্দ তুলে এক মনে চিবোতে থাকলেন পান। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বন্যা বললো : এ-কারের পরে এ-কার দিয়ে কোন উদাহরণ তো দিলেন না স্যার। ধ্যান ভেঙ্গে চোখ্ মেলে তাকালেন। তড়াক করে উঠেই দুলে দুলে হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগলেন, এ যে মেয়ে সেজে এসেছে। বন্যা তখনো বসে নি। দাঁড়িয়েই বললো, স্যার আর বলতে হবেনা। একেবারে এ-কারের বন্যা বয়ে গেছে। হাল্কা হেসে বললেন স্যার, এ-কার অ্যা-কার মিলিয়ে একটা বাক্য এবার তুমি বলো। সপ্রতিভ বন্যা সাথে সাথেই বলে ফেললো, সকাল বেলায় (ব্যালায়) খেয়ে এসেছি টেংরা (ট্যাংরা) মাছের ঝোল। হাসির বন্যার মাঝে তলিয়ে গেল বন্যার গলা। পরে কি যেন বললো শুনতে পাওয়া গেল না। 



সূত্র দুই : ধাতু (ক্রিয়ার মূল) কিংবা প্রতিপাদিকে (শব্দের মূল) ই-কার কিংবা ঋ-কার ছিল, পরবর্তী ধ্বনির প্রভাবে সেই ই-কার কিংবা ঋ-কার একবার এ-কার পরিণত হলে, আর কখনো কোন অবস্থাতেই সেই এ-কার অ্যা-কারান্ত উচ্চারিত হবে না।
যেমন :
কিন্ থেকে কেনা কিন্তু ক্যানা নয়
মিল্ থেকে মেলা কিন্তু ম্যালা নয়
লিখ্ থেকে লেখা কিন্তু ল্যাখা নয়
গিল্ থেকে গেলা কিন্তু গ্যালা নয়
মিশ্ থেকে মেশা কিন্তু ম্যাশা নয়
জিলা থেকে জেলা কিন্তু জ্যালা নয়
শিখ্ থেকে শিখা কিন্তু শ্যাখা নয়
মিষ্ থেকে মেষ কিন্তু ম্যাষ নয়
পিট্ থেকে পেটা কিন্তু প্যাটা নয়
রিচ্ থেকে রেচক্ কিন্তু র‌্যাচক নয়
লিহ্ থেকে লেহন্ কিন্তু ল্যাহন্ নয়
বিদ্ থেকে বেদ্ কিন্তু ব্যাদ নয়
নী থেকে নেতা কিন্তু ন্যাতা নয়
দিশ্ থেকে দেশ্ কিন্তু দ্যাশ নয়
মিদ্ থেকে মেদ্ কিন্তু ম্যাদ নয়
চিল্ থেকে চিল্লানো কিন্তু চ্যাল্লনো নয়
মিরাজ্ থেকে মেরাজ্ কিন্তু ম্যারাজ্ নয়
কিতাব্ থেকে কেতাব্ কিন্তু ক্যাতাব নয়
সিতার থেকে সেতার কিন্তু স্যাতার নয়
বিতার থেকে বেতার কিন্তু ব্যাতার নয়
মিজাজ্ থেকে মেজাজ্ কিন্তু ম্যাজাজ্ নয়
ইন্সাফ্ থেকে এন্সাফ্ কিন্তু অ্যানসাফ্ নয়
বিয়াদব্ থেকে বেয়াদব্ কিন্তু ব্যায়াদব নয়
বিতমিজ্ থেকে বেতমিজ্ কিন্তু ব্যাতমিজ্ নয়
ইনামুল্ থেকে এনামুল্ কিন্তু অ্যানামুল নয়
ইবাদত্ থেকে এবাদত্ কিন্তু অ্যাবাদত নয়
নৃপাল্ থেকে নেপাল্ কিন্তু ন্যাপাল নয়
গরম চা কখন রাখা হয়েছিল এতক্ষণ খেয়াল করেন নি স্যার। হঠাৎ দেখতে পেয়ে থেমে গেলেন তিনি। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বাম হাতে চায়ের গ্লাস তুলে নিয়ে সুখ সুখ ভাব করে দিলেন লম্বা চুমুক। গ্লাসের অর্ধেক শেষ করে ঘুরে দাঁড়ালেন আবার। চা ঠাণ্ডা কি গরম তাতে কিছু আসে যায় না কখনো। গ্লাস ধরেই শুরু করলেন ফের।



সূত্র তিন : সংস্কৃত থেকে আগত শব্দ অর্থাৎ তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে প্রায় ৯০-৯৫ ভাগ শব্দে এ-কারান্ত থাকে। কারণ সংস্কৃতে অ্যা নামক কোন ধ্বনি নেই। 
যেমন
প্রেম্ কিন্তু প্র্যাম নয়
বেদ্ কিন্তু ব্যাদ নয়
মেদ্ কিন্তু ম্যাদ নয়
রেবা কিন্তু র‌্যাবা নয়
বেত্র (বেত্ত্রো) কিন্তু ব্যাত্ত্র নয়
মেধা কিন্তু ম্যাধা নয়
সেতু কিন্তু স্যাতু নয়
মেরু কিন্তু ম্যারু নয়
ধেনু কিন্তু ধ্যানু নয়
কেয়ূর কিন্তু ক্যায়ুর নয়
প্রেরক কিন্তু প্র্যারক নয়
তেজ কিন্তু ত্যাজ নয়
হেমন্ত (হেমন্তো) কিন্তু হ্যামন্তো নয়
বেগ্ কিন্তু ব্যাগ নয়
পেচক্ কিন্তু প্যাচক নয়
বেতস্ কিন্তু ব্যাতস নয়
কেতন্ কিন্তু ক্যাতন নয়
কেদার কিন্তু ক্যাদার নয়
চেতনা (চেতোনা) কিন্তু চ্যাতনা হয়
তেজস্বী (তেজোশ্শি) কিন্তু ত্যাজস্বী নয়
দেবকী (দেবোকী) কিন্তু দ্যাবকী নয়
দেবর্ষি (দেবোরসী) কিন্তু দ্যাবরসি নয়
বেনী (বেনী) কিন্তু ব্যানী নয়
ভেদ্দ (ভেদ্দো) কিন্তু ভ্যাদ্দো নয়
মেদিনী (মেদিনী) কিন্তু ম্যাদিনী নয়
মেনকা (মেনোকা) কিন্তু ম্যানকা নয়
রেবতী (রেবোতী) র‌্যাবতী নয়
শেখর (শেখর) কিন্তু শ্যাখর নয়
সেবক (সেবক) কিন্তু স্যাবক নয়


শুদ্ধ উচ্চারণ বিষয়ক বক্তৃতা : শ, স ও ষ এর সূত্র - অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস

পর্ব : ৭

এবার ব্যঞ্জন বর্ণের উচ্চারণ শুরু হলো :
আজ শ, স ও ষ এর সূত্র

নির্ধারিত সময়ের একটু পরেই এলেন স্যার। কেন যেন বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল তাঁকে। চেয়ারে বসে নিরাবেগে দৃষ্টি মেলে ধরলেন সামনের দিকে। তপন বেশ করিৎকর্মা ছেলে, সবকিছুর খবরাখবর ভালই রাখে। চট্ করে জিজ্ঞেস করলো, স্যার, আপনি নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ম্লান মুখে ফুটে উঠলো হাসি, বললেন, শরীরের উপর বেশী ধকল গেলেতো তাড়াতাড়ি বিকল হবেই। এতো হলো একটি যন্ত্র। কেবল মন্ত্র দিয়েতো আর চালানো যায় না। আরাম যদি হারাম হয়, ব্যারামতো তখন ধরবেই। স্যারের জোড়ায় জোড়ায় কথা চলতে থাকতো আরো কিছুক্ষণ। কিন্তু রাজশাহীর মিলন ফস্ করে জানতে চাইলো, স্যার, এখন আপনার সরীর ভালো তো? হো হো হাসির ছররা বয়ে গেলো ক্লাসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে ক্রোধান্বিত মিলন বসে পড়লো। 
হাসি থামতেই স্যার শুরু করলেন, বাঙলায় তিনটি শ আছে। তালব্য, মুর্ধণ্য এবং দন্ত্য। তিনটি শ এর রূপ আলাদা হলেও বাঙলা ভাষায় একটিই শ (Sh) উচ্চারিত হয় প্রধানত মূলধ্বনি হিসেবে। তবে কোথাও কোথাও শ (Sh) কিন্তু স (S) এর মতো উচ্চারিত হয়।
সেটা কোথায় হয়? যখন শ সহধ্বনি হয়ে যায় অর্থাৎ অন্যধ্বনির প্রভাবে সেই শ টা স এর মতো হয়ে যায়। ত, থ, ন, র, ল এইসব দন্ত্য বা দন্ত্যমূলীয় বর্ণের সঙ্গে স বা শ যখন সংযুক্ত অবস্থায় উচ্চারিত হয়, তখন তার উচ্চারণ হয়ে যায় রীতিমতো স (S) এর মতো। যেমন :
মস্ত - মস্তো
সমস্ত - শোমোস্তো
দরখাস্ত - দরখাস্তো
বরখাস্ত - বরখাস্তো
প্রস্তুতি - প্রোস্তুতি
ব্যস্ত - ব্যাস্তো
গ্রস্ত - গ্রোস্তো
মস্তক - মস্তোক
বস্তি - বোস্তি
আস্তে - আস্তে
রাস্তা - রাস্তা
খাস্তা - খাস্তা
নাস্তা - নাস্তা
কাস্তে - কাস্তে
দস্তা - দসতা
কুস্তি - কুস্তি
দোস্তি - দোস্তি
বন্দোবস্ত - বন্দোবস্তো
ধস্তাধস্তি - ধস্তাধোস্তি
খিস্তি - খিস্তি
সুস্থ - শুস্থো
আস্থা - আস্থা
স্থিতি - স্থিতি
উপস্থিত - উপোস্থিত্
অস্থাবর - অস্থাবর
মুখস্ত - মুখোস্তো
ব্যবস্থা - ব্যবোস্থা
স্থান - স্থান
স্নান - স্নান (Snan)
স্নেহ - স্নেহো (Sneho)
স্নিগ্ধ - স্নিগ্ধ (Snigdho)
স্নায়োবিক - স্নায়োবিক (Snayobic)
অশ্লীল - অস্লীল
শ্লেষ - স্লেস (Slesh)
শ্লোক - স্লোক (Sloke)
শ্রোতা - স্রোতা (Srota)
শ্রবণ - স্রবন (Srobon)
শৃগাল - সৃগাল (Sreegal)
শৃঙ্গ - সৃংগো (Sreengo)
শ্রাবণ - স্রাবোন (Srabon)
শ্রীলঙ্কা - স্রীলংকা (Sreelonka)
শ্রীমান - স্রীমান (Sreeman)
প্রশ্ন - প্রোস্নো
শ্রদ্ধা - স্রোদ্ধা (Sroddha)
শ্রেয়সী - স্রেয়োশি (Sreyoshi)
বিশ্রী - বিস্স্রি
শ্রেষ্ঠ - স্রেশ্ঠো (Sreshtho)
সংশ্লিষ্ঠ - শঙস্লিশ্টো (Shongslishto)
শ্লাঘা - স্লাঘা (Slagha)
শ্লথগতি - স্লথোগোতি (Slothogoti)
এতগুলো উদাহরণ স্যার সহজে দেন না। আজ কেন জানি উন্মানা হয়ে নাকি অসুস্থ শরীরে জেদ চেপে যাওয়ায় একনাগাড়ে উদাহরণগুলি দিয়ে ধপ্ করে চেয়ারে বসে পড়লেন। লাল রঙা চায়ের গ্লাসের দিকে লোলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গা এগিয়ে দিলেন চেয়ারের পিছনে।
মিনা মিন্মিন্ করে বললো, স্যার ঞ্জ এবং জ্ঞ এর উচ্চারণ সস্পর্কে কিছু বলবেন কি? হতাশার ভাব বজায় রেখেই গাম্ভীর্যের সাথে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করলেন, ঞ এর সাথে জ যুক্ত হয়ে ঞ্জ যুক্তধ্বনি তৈরী হয়। এতে ঞ এর উচ্চারণ ন এর মতো হয়, কিন্তু জ এর উচ্চারণ অবিকৃত থাকে। যেমন :
ভঞ্জ - ভন্জো
রঞ্জ - রন্জো
গঞ্জিত - গোন্জিতো
ব্যঞ্জন - ব্যান্জোন্
খঞ্জনা - খন্জোনা
অঞ্জনা - অন্জোনা
একটু টেনে দম নিয়ে শুরু করলেন ফের।
জ এর সাথে ঞ যুক্ত হয়ে জ্ঞ যুক্তধ্বনি তৈরী হয়। শব্দের আদিতে জ্ঞ এর উচ্চারণ সাধারণত গঁ বা গ্যঁ এর মতো এবং শব্দের মধ্যে ও অন্তে গ্গঁ এর মতো হয়। যেমন :
জ্ঞাত - গ্যাঁতো
জ্ঞান - গ্যাঁন
জ্ঞাপক - গ্যাঁপোক্
জ্ঞেয় - গেঁয়ো
বিজ্ঞান - বিগ্গ্যাঁন
বিজ্ঞপ্তি - বিগগোঁপ্তি
অজ্ঞান - অগ্গ্যাঁন
অবজ্ঞা - অবোগ্গাঁ
অজ্ঞ - অগ্গোঁ
বিজ্ঞ - বিগ্গোঁ
দৈবজ্ঞ - দোইবোগ্গোঁ
বিশেষজ্ঞ - বিশেশোগ্গোঁ
মিনা আবার বলে ফেললো, ঞ এর সাথে আর কোনো বর্ণ যুক্ত হয়ে যুক্তধ্বনি তৈরী করে কি?
স্যার ঠাণ্ডা গলায় বললেন, হ্যাঁ, চ, ছ, ঝ এই বর্ণগুলিও ঞ এর সাথে যুক্ত হয় এবং জ্ঞ এর মতোই ঞ এর উচ্চারণ ন এর মতো হয়। যেমন-
পঞ্চ - পন্চো
মঞ্চ - মন্চো
লাঞ্ছিত - লান্ছিতো
ঝঞ্ঝা - ঝন্ঝা
ঝঞ্ঝনা - ঝন্ঝোনা
কাঞ্চন - কান্চোন
মিনা আবার যেন কি বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু স্যারের অসুস্থ ও ক্লান্ত শরীরের কথা ভেবে একসঙ্গে বেশ কয়েকবার পিছন থেকে শ্ শ্ শব্দ করে মিনাকে থামিয়ে দিল। চুপ্চাপ্ একটু বসে থেকে বিমর্ষ স্যার আস্তে আস্তে বাইরে চলে গেলেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন